মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই ৩১ জানুয়ারি ২০১৭
১। বেঠিক পদ্ধতিতে ‘সঠিক’ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নের কাজটি ভেস্তে যেতে বসেছে। বিদ্যমান ২ লাখ ৩০ হাজার সদস্যের মধ্যে কারা ভুয়া, তা যাচাই-বাছাই এবং নতুন অন্তর্ভুক্তির জন্য সারা দেশে কমিটি করে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। শতাধিক কমিটির সদস্যদের নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, ৩৫টি উপজেলার ৪৫টি কমিটি পুনর্গঠিত হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের, নতুন আবেদন জমা পড়েছে প্রায় দেড় লাখ!
এভাবে বারবার আমলা ও রাজনীতিবিদদের দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ তালিকা তৈরি করা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার শামিল। পাশাপাশি, এ ধরনের তালিকার সুবাদে মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া রাষ্ট্রীয় সুবিধাও বেহাত হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। প্রথম আলোর সোমবারের সংবাদ থেকে দেখা যাচ্ছে, মৃত ও ভিন্ন এলাকার ব্যক্তিকেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই কমিটিতে রাখা হয়েছে। একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়া ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে। সারা দেশ থেকে ‘মুক্তিযোদ্ধারাই’ এসব অভিযোগ করছেন। ইতিমধ্যে কমিটির সম্মানী ও খরচ বাবদ প্রায় সোয়া চার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে।
প্রতিটি সরকার আসে আর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে যায়। ছয়বার তালিকা সংশোধিত হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বদলেছে ১০ বার! আমাদের হাত দিতে হবে সমস্যার গোড়ায়। তালিকা প্রণয়ন আমলা ও রাজনীতিবিদ বা সাংসদনির্ভর হলে চলবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত লাল মুক্তি বার্তা, ভারতীয় তালিকা, বিভিন্ন রেজিমেন্ট ও সেক্টর কমান্ডের তালিকা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষকদের মাধ্যমে যাচাই করে নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী, জেনারেল ওসমানীসহ যাঁদের সই জাল করে নকল সনদ বানানো হয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করা অসম্ভব নয়। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা, বয়স ও তালিকা প্রণয়নপদ্ধতি বিষয়ে পরীক্ষিত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।
মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া রাষ্ট্রীয় বিশেষ সুবিধা, নাতি-নাতনি পর্যন্ত সংরক্ষিত চাকরির কোটাসহ আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার সুযোগ নিতেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ভুয়া ব্যক্তিরা ঢুকে পড়েছেন। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মত প্রণিধানযোগ্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘সরকার যদি এখন ঘোষণা দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হবে না এবং আহত ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছাড়া আর কাউকে কোনো সুবিধা দেওয়া হবে না, তাহলে কাল থেকে আর কেউ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম তুলতে চাইবে না।’

২। ১৭ নভেম্বর ২০১৭
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত সোমবার জাতীয় সংসদে যা বলেছেন, তা পুরো সত্য নয়। আংশিক সত্য। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে যে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, তিনি তার পুরো দায় আদালতের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কোনো তালিকা নিয়ে আপত্তি ওঠার পরই সেটি আদালতে গিয়েছে। মন্ত্রণালয় যদি পুরো তালিকা বাতিল না করে নাম যাচাই–বাছাই করে আপত্তি জানাত, তাহলে বিষয়টি হয়তো আদালতে যাওয়ারই প্রয়োজন হতো না।
মন্ত্রী মহোদয়ের ভাষ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁর বয়স চার বছর ছিল, তাঁকেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে আদালত তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশে তিনি বিব্রতবোধ করছেন বলে জানিয়েছেন। কোনো তালিকায় চার বছরের শিশুকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর চেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আশা করি, উচ্চতর আদালতে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে এর প্রতিকার পাওয়া যাবে। জাতীয় সংসদের স্পিকারও সে রকম পরামর্শ দিয়েছেন।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিল (জামুইকা) মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরিতে যে কী পরিমাণ অনিয়ম-দুর্নীতি করেছে, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। মন্ত্রী মহোদয়ের নিশ্চয়ই মনে আছে, আরও অনেকের মতো ২০১৪ সালে পাঁচ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হয়ে গিয়েছিল, যার মধ্যে খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিবও ছিলেন। ভুয়া সনদ দিয়ে তাঁরা চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময়ে কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় কিংবা মন্ত্রণালয়ের কোনো পদাধিকারীকে বিব্রত বোধ করতে দেখা যায়নি। তখন মন্ত্রণালয় শক্ত ব্যবস্থা নিলে হয়তো আমরা আগেই একটি নির্ভুল তালিকা পেতাম।
কেবল মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নয়, মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি সুহৃদদের দেওয়া স্বর্ণপদকে খাদ মেশানোর কাজটিও হয়েছিল মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের যোগসাজশে। আর সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বদলের পেছনের রহস্যটা জানা দরকার।
কোনো তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকলে অবশ্যই তাঁর নাম বাদ দিতে হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ ঘটনা। সেই মুক্তিযুদ্ধের বীরদের তালিকা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হোক।
৩। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই–বাছাই নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ থামছে না
*অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে তালিকায় নাম তোলার অভিযোগ *ভাতাপ্রাপ্ত ২৪৭ জন বাদ পড়ায় গোপালগঞ্জে মানববন্ধন।
সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই নিয়ে বিতর্ক চলছেই। একদিকে অভিযোগ উঠেছে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম রাখার জন্য অর্থ লেনদেনের, অন্যদিকে আপত্তি উঠেছে কমিটির সদস্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন আবেদন করা ৯০ ভাগের দেওয়া তথ্যই ভুল। পাশাপাশি যাঁরা যাচাই-বাছাই করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও উঠেছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ।
এসব কারণে নির্ধারিত সময়ে যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হয়নি। মাঠপর্যায় থেকে ২০ মের মধ্যে যাচাই-বাছাই করা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) না পৌঁছালে আগামী অর্থবছর থেকে সম্মানী ভাতা বা উৎসব ভাতা দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হলেও অর্ধেক আবেদনও পৌঁছায়নি। নিয়ম ভঙ্গ করে এখনো চলছে যাচাই-বাছাই।
মুক্তিযোদ্ধার পুরোনো তালিকায় যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে এবং যাঁরা নতুন করে সনদ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন, তাঁদের ব্যাপারে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি করতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ১২ জানুয়ারি একটি গেজেট প্রকাশ করে। সারা দেশে আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ৪৮৮টি উপজেলা ও ৮টি মহানগর কমিটি কাজ শুরু করে ২১ জানুয়ারি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য অনলাইনে জমা পড়ে প্রায় দেড় লাখ আবেদন।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এ পর্যন্ত জেলা পর্যায় থেকে যে তালিকা এসেছে, তাতে ৫ শতাংশও মুক্তিযোদ্ধা নন। আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ এসেছে, তা খতিয়ে দেখছি। টাকা লেনদেনের বিষয়ে আমাদের কাছেও অভিযোগ এসেছে।’
অভিযোগের পর অভিযোগ
গত বুধবারও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে গোপালগঞ্জের ভাতাপ্রাপ্ত ২৪৭ জন বাদ পড়ায় এলাকায় মানববন্ধন করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. মজিবর রহমান অভিযোগ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধার গেজেট, মুক্তিবার্তা, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সনদে নাম থাকার পরও যাচাই-বাছাই কমিটি ‘দুর্নীতির মাধ্যমে’ ২৪৭ জনকে তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। অন্যদিকে কাগজপত্র নেই এমন ৫৫২ জনকে যাচাই-বাছাই কমিটি সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।

তবে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য গোপালগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদরুদ্দোজা বদর দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সরকার একটি নীতিমালা করেছে এবং সে অনুযায়ী যাচাই-বাছাইয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।’এর আগে রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম নিয়ে কমিটির দুই সদস্যের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি অভিযোগ দিয়েছেন স্থানীয় ৮৯ জন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাজবাড়ী সদর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে কমিটির সদস্য মহসীন উদ্দিন এবং আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, তাঁরা যাচাই-বাছাইয়ের
নামে ভয়ভীতি দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন।মহসীন উদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে
প্রথম আলোকে বলেন, যাচাই-বাছাইতে কিছু অমুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়া ব্যক্তি তালিকাভুক্ত হওয়ার চেষ্টায় মিথ্যা অভিযোগ করেছে।আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা না হওয়ার অভিযোগ ওঠায় তিনি
প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বয়স নিয়ে আইনের ব্যত্যয় হলে বিষয়টি মন্ত্রণালয় দেখবে।’বরিশালে সনদ সংগ্রহ এবং তালিকায় নাম রাখা নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছে বাবুগঞ্জ উপজেলায়। বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার মহিউদ্দিন মানিক
প্রথম আলোকে বলেন, যাচাই-বাছাই কমিটিতে যাঁদের রাখা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।বাবুগঞ্জ উপজেলার মহিষাদী গ্রামের আলেয়া বেগম মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামী মোসলেম আলী হাওলাদার মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছে। মো. কাঞ্চন মৃধা
প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সনদ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছে। একই অভিযোগ করেন মো. হাকিম আলী।বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক এনায়েত হোসেন চৌধুরী
প্রথম আলোকে বলেন, বাবুগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অংশ অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আবার যাচাই-বাছাই কমিটিও অনেক স্থানে রাজনৈতিকভাবে করা হয়েছে। তবে জাল সনদ নিয়েও অনেকে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য এসেছিলেন। তাঁরা বাদ পড়েছেন।বাবুগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. আনিচুর রহমান
প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থ লেনদেন হয়েছে এটা দ্বিমত করি না। শুনেছি লোকে গরু, জমি বেচে এবং সুদে ঋণ নিয়েও নাকি টাকা দিয়েছে।’
যাচাই-বাছাই শেষে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বগুড়ার শেরপুরে বেশির ভাগের নাম বাদ দেওয়ার সুপারিশ করায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সন্তানেরা বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়া তালিকায় বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান ও বাংলাদেশ ব্যাংক বগুড়ার সহকারী পরিচালক আবদুর রউফ খানও রয়েছেন।এ প্রসঙ্গে মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাকিস্তান আমলে তিনি শেরপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৭০ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন।বাংলাদেশ ব্যাংক বগুড়ার সহকারী পরিচালক আবদুর রউফ খান বলেন, তিনি ছিলেন ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। সরকারি গেজেটভুক্ত এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সনদপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁকে অন্যায়ভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে।নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় তিন দফা কমিটিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে
৪। দোহারে অনিয়মের অভিযোঃ মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই–বাছাই স্থগিত
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
ঢাকার দোহার উপজেলায় অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে গত সোমবার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা যাচাই-বাছাই কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় কর্তৃক সর্বশেষ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই এবং গেজেট থেকে বাদ পড়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলাকালে অনলাইনে প্রায় আড়াই হাজার ফরম পূরণ হয়। এ নিয়ে দোহার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একাংশের মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। দোহার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম সোমবার অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত আবেদন দেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বলেন, উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করার জন্য যে কমিটি করা হয়েছে, সেটা সঠিকভাবে করা হয়নি। তা ছাড়া যে প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে, তাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই বাদ পড়ে যাবেন। প্রতিটি ইউনিয়নের পাঁচ-সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে কমিটিতে রাখা হলে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার অনিয়ম দূর হবে এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই তালিকায় চলে আসবেন।
যাচাই-বাছাই কমিটির বিশেষজ্ঞ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মনজুর এ এলাহী মোহাম্মদ আল আমিন বলেন, ‘উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও সুবিধাভোগী মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন ৫০৭ জন। আর গেজেটভুক্ত রয়েছেন ৫৬১ জন। এ ছাড়া লাল বইয়ে তালিকাভুক্ত রয়েছেন ২৯৪ জন। তবে কী কারণে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে এবং কবে থেকে আবার এ প্রক্রিয়া শুরু হবে সে বিষয়ে আমি অবগত নই।’
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত আটটি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটি ইউনিয়নে (নয়াবাড়ি, মাহমুদপুর, বিলাসপুর, কুসুমহাটি ও রাইপাড়া) মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া গত ৩০ জানুয়ারি পৌরসভা ও সুতারপাড়া ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ের দিন ধার্য ছিল। সেদিন যাচাই-বাছাই না হওয়ায় কমিটি বাতিলের দাবিতে মুক্তিযোদ্ধারা উপজেলা পরিষদ চত্বরে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভ শেষে ইউএনও বরাবর দেওয়া অভিযোগে নতুন কমিটি গঠনের দাবি জানানো হয়।
উপজেলার ডেপুটি কমান্ডার মো. শাহাজাহান বলেন, উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটি ইউনিয়নের যাচাই-বাছাই শেষ হয়েছে। বাকি ইউনিয়নের যাচাই-বাছাইয়ের তারিখ কয়েক দিনের মধ্যে জানানো হবে।
যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য কমান্ডার আবুল কালাম বলেন, ফরম ক্রেতাদের বেশির ভাগই অপরিচিত মুখ। কমিটির আরেক সদস্য বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. রজ্জব আলী মোল্লা বলেন, ফরম নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা হবে।
ইউএনও কে এম আল আমীন বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে একটি অভিযোগ পেয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি
অবহিত করেছি। বর্তমানে যাচাই-বাছাই স্থগিত আছে।’
৫। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই–বাছাই নিয়ে জগাখিচুড়ি
রোজিনা ইসলাম ৩০ জানুয়ারি ২০১৭
📷.মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর কে ভুয়া, নতুন করে কারা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন, সেটা যাঁরা যাচাই-বাছাই করছেন তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে উঠেছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অভিযোগ। সারা দেশ থেকে চিঠি, ফ্যাক্স ও ই-মেইলে এসব অভিযোগ আসতে থাকায় যাচাই-বাছাই কমিটিগুলো দফায় দফায় সংশোধন করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গত কয়েক দিনে ৩৫টি জেলার ৪৫টি উপজেলার কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। স্থগিত করা হয়েছে পাঁচটি কমিটি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিনই অভিযোগ আসছে। এরই মধ্যে শতাধিক উপজেলায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে দাবি করেছেন, যাচাই-বাছাই কমিটির ওই সদস্যদের সত্যিকার পরিচয় যাচাই-বাছাই করা উচিত। কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা সাধারণ মানুষকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম তুলে দেবেন বলে আশ্বাস দিয়ে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত বৃহস্পতিবার
প্রথম আলোকে বলেন, এত বিপুলসংখ্যক কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসা বিস্ময়কর।
মুক্তিযোদ্ধার পুরোনো তালিকায় যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে এবং যাঁরা নতুন করে সনদ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন, তাঁদের ব্যাপারে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি করতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১২ জানুয়ারি একটি গেজেট প্রকাশ করে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য অনলাইনে জমা পড়েছে প্রায় দেড় লাখ আবেদন। এ ছাড়া প্রতিদিনই আবেদন আসছে। সারা দেশে আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ৪৮৮টি উপজেলা ও ৮টি মহানগর কমিটি কাজ শুরু করে ২১ জানুয়ারি থেকে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি অভিযোগ
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে যাচাই-বাছাই কমিটির ফরহাদ হোসেন ও আবু তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তাতে তাঁরা বলেছেন, এ দুজন এলাকার নিরীহ লোকদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ভুয়া নাম তোলার আশ্বাস দিচ্ছেন।
তবে ফরহাদ হোসেন এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা। আমাকে হেয় করার জন্য এসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। পারলে অভিযোগ প্রমাণ করুক।’ অভিযোগকারীদের মধ্যে একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ফরহাদ হোসেনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তের জন্য একজন মন্ত্রীও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালককে চিঠি দিয়েছেন। সাতকানিয়া উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গঠিত কমিটি থেকে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আবু তাহের, ডেপুটি কমান্ডার মিলন কুমার ভট্টাচার্য, নুরুল আলম মন্টু ও নাছির উদ্দিনকে বাদ দিয়ে নতুনভাবে ‘প্রকৃত’ মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্তির দাবি তুলেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবু তাহের পাল্টা অভিযোগ করেন, ‘হাফেজ আহমদ, নুরুল ইসলামসহ যাঁরা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তাঁরাই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। আমাকে কমিটি থেকে সরাতে পারলে তাঁরা সরকারি ভাতা চালুসহ যাচাই-বাছাইয়ের সময় প্রভাব দেখাতে পারবেন এই আশায় ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন। আমি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। ওনারা বাদ পড়ার ভয়ে কমিটি থেকে আমাকে সরানোর জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।’ উপজেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক হাফেজ আহমদ অভিযোগ করেন, ‘তালিকায় নাম তোলার কথা বলে সাতকানিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের আবেদনকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছেন।’ একই অভিযোগ এসেছে ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার যাচাই-বাছাই কমিটির সুলতান আহম্মেদ হাওলাদার ও মজিবর রহমানের বিরুদ্ধে। সুলতান আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চলছে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে অভিযোগকারী নজরুল হক জমাদ্দারের দাবি, সুলতান প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। এ বিষয়ে তাঁদের কাছে প্রমাণ আছে। একইভাবে মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা লিখিত অভিযোগ করেছেন, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের যে প্রতিনিধি যাচাই-বাছাই কমিটিতে দেওয়া হয়েছে, সেই খলিলুর রহমান নিজেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। বিগত সরকারের আমলে তিনি ভুল তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। তাই তাঁর সনদ আগে যাচাই-বাছাইয়ের অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁরা। নরসিংদীর পলাশ উপজেলার কমিটি থেকে মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান মিয়াকে বাদ দেওয়ার আবেদন এসেছে। এতে বলা হয়েছে, তিনি শতাধিক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকায় তোলার সুপারিশ করেছেন।
রাউজানে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যদের কারও কারও
লাল মুক্তি বার্তা এবং ভারতীয় তালিকায় নাম না থাকার অভিযোগ উঠেছে। ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলা কমিটিতে বাইরের উপজেলা থেকে একজনকে সদস্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ফরিদপুরের উপজেলা কমান্ডার গফফার মিয়া। অভিযোগ উঠেছে, নড়াইল জেলার যাচাই-বাছাই কমিটির জামুকা প্রতিনিধি মো. লিয়াকত হোসেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। তিনি অর্থের বিনিময়ে অনেক অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ অভিযোগ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান বিশ্বাস। শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে যাচাই-বাছাই কমিটি থেকে বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাহাব উদ্দিনের নাম বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সেখানকার মুক্তিযোদ্ধারা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান
প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহাব উদ্দিন ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছিলেন। জানতে চাইলে সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। শত্রুতা করে সবাই এসব করছে।’
বেশ কয়েকটি কমিটি পুনর্গঠন
গত কয়েক দিনে ৩৫টি জেলার ৪৫টি উপজেলার কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচটি কমিটি স্থগিতও করা হয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল বিকেলে মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, দেড় বছর আগে একবার কমিটি করা হয়েছিল। এরপর কিছু কমিটি নতুন করে করা হয়েছে। সারা দেশ থেকে কারও সুপারিশে কোনো কমিটি করা হয়নি। তবে আলাপ-আলোচনা করা হয়েছে। তারপরও যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তাঁদের বাদ দিয়ে সংশোধিত কমিটি প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো কোনো কমিটি বাতিলও করা হয়েছে।
৬। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা নেই ১২ এপ্রিল ২০১৭
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের কার্যক্রম পরিচালনায় আইনগত বাধা কেটেছে। এ বিষয়ে দেওয়া আদেশ সংশোধন করে দিয়েছেন উচ্চ আদালত। আজ মঙ্গলবার বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি এম ফারুকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের করা সংশোধন আবেদনের শুনানি নিয়ে আদেশ দেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমাতুল করিম ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এ আর এম হাসানুজ্জামান। অন্যদিকে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এম সাইফুল বারী ও আইনজীবী আব্দুল মান্নান। পরে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এ আর এম হাসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ১৯ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে ৪৭০টি কমিটি গঠন করা হয়। মন্ত্রণালয়ের ওই স্মারকের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দুটি উপজেলা কমিটি গঠন নিয়ে হাইকোর্টে পৃথক রিট হয়। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুলসহ মন্ত্রণালয় পুরো স্মারকের কার্যকারিতা স্থগিত করে দেন। একটি মামলা শুনানিতে গত সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মার্চের একটি স্মারক নজরে এলে আদালত বলেন, পুরো স্মারক স্থগিত করা হয়নি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপক্ষ আগে দেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ সংশোধন চেয়ে আবেদন করে। হাসানুজ্জামান বলেন, হাইকোর্ট একটিতে (ফরিদপুর উপজেলা) রুল খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে ৪৭০ টির ক্ষেত্রে কার্যক্রম পরিচালনায় স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলো। অপরটিতে (টুঙ্গিপাড়া) স্থগিতাদেশ বহাল রেখে আদেশ সংশোধন করে দিয়েছেন, শুধু টুঙ্গিপাড়া হবে। ফলে টুঙ্গিপাড়া ছাড়া বাকি যাচাই-বাছাইয়ের কার্যক্রম পরিচালনায় আইনগত কোনো বাধা নেই। আইনজীবী সূত্র বলেছে, ৪৫৯টি উপজেলা কমিটি, তিনটি জেলা কমিটি ও আটটি মহানগর কমিটি (৪৭০ টি) পুনর্গঠন করে গত ১৯ জানুয়ারি আদেশ জারি করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। যথাযথভাবে কমিটি গঠন করা হয়নি উল্লেখ করে রিট (১০২৭ / ২০১৭) করেন ফরিদপুরের একটি উপজেলা নিয়ে এক মুক্তিযোদ্ধা। আর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলা নিয়ে অপর রিটটি (১১০৮ / ২০১৭) করেন আরেক মুক্তিযোদ্ধা। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২৩ জানুয়ারি ও ২৯ জানুয়ারি হাইকোর্ট রুলসহ চার মাসের জন্য কার্যক্রম পরিচালনায় স্থগিতাদেশ দেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক আদেশে গত ১৯ জানুয়ারি প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির ওই কার্যক্রম স্থগিত করে। এরপর হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে দুটি আবেদন করে, শুনানি নিয়ে ৩০ মার্চ আদালত হাইকোর্টে রুল শুনানি করতে বলেন। এর ধারাবাহিকতায় রুল শুনানির জন্য ওঠে। এ দিকে আপিল বিভাগের আদেশের কপি পাওয়া যায়নি জানিয়ে ৫ এপ্রিল এক বিজ্ঞপ্তিতে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপজেলা বা জেলা বা মহানগর যাচাই-বাছাই সকল (৪৭০ টি) কমিটির কার্যক্রম স্থগিত রাখা হল। ১১০৮ নম্বর রিট মামলায় আট জেলা এবং ১০২৭ নম্বর রিট মামলায় সকল (৪৭০ টি) যাচাই-বাছাই কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয় বলে এতে উল্লেখ করা হয়।
৭। মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই কার্যক্রম চলবে ২০ মার্চ ২০১৭
মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ের কার্যক্রম চলবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের করা রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী, চাঁদপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, ঝালকাঠি ও সিলেটের যাচাই-বাছাই কমিটি স্থগিত করে। পরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ২৯ জানুয়ারি ও ১৬ ফেব্রুয়ারি ভিন্ন ভিন্ন প্রজ্ঞাপন দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই কার্যক্রম স্থগিত করে। মন্ত্রণালয় জানায়, ১৯ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ লিভ টু আপিল মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের ২৯ জানুয়ারির আদেশে অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ প্রদান করেছে। এ অবস্থায় অন্য কোনো মামলা বা রিট পিটিশনের আদেশ দ্বারা স্থগিতাদেশ না থাকলে উপজেলা, জেলা মহানগর যাচাই বাছাই কার্যক্রম চলবে। মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই বাছাইয়ের জন্য মহানগর, জেলা ও উপজেলায় কমিটি করতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ১২ জানুয়ারি একটি গেজেট প্রকাশ করে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই বাছাইয়ের বিষয়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল গত বছরের ১০ ডিসেম্বর একটি নির্দেশিকা জারি করে। পরে গত ৫ জানুয়ারি আরেকটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাছাইয়ের তারিখ পরিবর্তন করা হয়। এরপর ২১ জানুয়ারি আট জেলার জন্য যাচাই বাছাই কমিটি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়।
৮। আজ জামুকার সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বয়স নয়, তথ্য যাচাই করেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণ ০৭ জানুয়ারি ২০১৫
বয়স দিয়ে নয়, আবেদনসহ সব তথ্য যাচাই করেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। আজ বুধবার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সভায় এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৯৭১ সালে বয়স ১৩ বা ১৫ বছরের নিচে ছিল—এমন কেউ মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবেন না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এই প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কম বয়সীদের মধ্যেও অনেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। এ জন্য বয়স নয়, যেকোনো আবেদন উপজেলা ও মহানগর কমিটি যাচাই-বাছাইয়ের পর ওই ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা কি না, তা নির্ধারণ করা হবে।
মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য অনলাইনে ১ লাখ ২৩ হাজার ১৫৪টি এবং সরাসরি ১০ হাজার ৯০০টি আবেদন জমা হয়েছে। আবেদনে উপজেলা বা জেলার নাম উল্লেখ করা হয়নি, এমন আবেদন পাওয়া গেছে ৫ হাজার ৫৫৩টি। সারা দেশে উপজেলা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ে আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ৪৮৮টি উপজেলা ও ৮টি মহানগর কমিটি গঠন করা হবে। যাচাই-বাছাইসহ স্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়ার কাজ চলতি বছরের ২৬ মার্চ শেষ হবে।
সূত্র জানায়, জামুকার ২৫তম সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, একাত্তরে বয়স ১৫ বছরের নিচে ছিল, এমন কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির আবেদন করতে পারবেন না। তারপর এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগঠনের আপত্তি মন্ত্রণালয়ে আসতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে মন্ত্রণালয় একাত্তরে যাঁদের বয়স ১৩ বছরের নিচে ছিল, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা নন—এমন বিধান রেখে মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা করে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৩ বছর পর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা অত্যন্ত সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর বিষয়। তথাপি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নিরূপণের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা জরুরি। মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ নীতিনির্ধারণী বিষয় হওয়ায় জামুকা আইন, ২০০২ অনুযায়ী জামুকার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণ করতে বলেছেন।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উপজেলায় আবেদন যাচাই-বাছাই কমিটির প্রধান হবেন স্থানীয় সাংসদ। কমিটিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি, জেলা কমান্ডার বা তাঁর মনোনীত প্রতিনিধি, উপজেলা কমান্ডার, যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, জামুকার সদস্য, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) থাকবেন। তবে কমিটির সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা হতে হবে। সাংসদ মুক্তিযোদ্ধা না হলে মন্ত্রণালয় ওই কমিটির সভাপতি হিসেবে একজন প্রতিনিধি দেবে। মহানগরে সভাপতি হবেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। সদস্য থাকবেন আরও পাঁচজন। যাচাই-বাছাইয়ের সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত থাকবেন। আবেদনকারী বা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কেউ আপত্তি জানালে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি কোথায়, কার অধীনে, কী কী অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের (বীরাঙ্গনা) তালিকা হবে ভিন্ন।
প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে যাঁরা নবম, দশম শ্রেণির ছাত্র বা এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন, তাঁদের প্রকৃত বয়স তখন যথাক্রমে ১৫ থেকে ১৭ বছর হলেও নিবন্ধনে বয়স প্রকৃত বয়সের চেয়ে দুই থেকে তিন বছর কম দেখানো হয়। ফলে একাত্তরের ২৬ মার্চ যেসব ছাত্রের প্রকৃত বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছর ছিল, তাঁদের এসএসসির সনদ অনুসারে তখন বয়স ছিল ১৩ বা ১৪ বছর। এ ছাড়া ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সী অনেক কিশোর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের মুক্তিযোদ্ধা/যুব শিবিরে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।
নারী মুক্তিযোদ্ধা: নতুন সংজ্ঞায় মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকারদের নির্যাতনের শিকার নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যাঁদের এত দিন বীরাঙ্গনা বলা হতো। এঁদের সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। তাঁদের আলাদা তালিকা হবে। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা যেসব সুযোগ-সুবিধা পান, তাঁরাও তা পাবেন।
৯। ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধার বিবৃতি
মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি নিয়ে বিবৃতির প্রতিবাদ
চট্টগ্রাম ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
চট্টগ্রাম নগরের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি নিয়ে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার যৌথ বিবৃতির প্রতিবাদ জানিয়েছেন ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা।
সম্প্রতি ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, চট্টগ্রাম নগরের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে গঠিত হয়েছে।
১১ জন মুক্তিযোদ্ধার ওই বিবৃতিকে মিথ্যা, কাল্পনিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিহিত করে ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ, অনৈক্য, বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘অভিযোগকারীদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন যাঁরা বিগত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনে বর্তমান মহানগর কমান্ডার মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন প্যানেলের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটে পরাজিত হন। তাঁদের অনেকেই অতীতে ফ্রিডম পার্টি ও বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। এতেই বোঝা যায়, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাঁরা এ ধরনের কাল্পনিক অভিযোগ করে যাচাই-বাছাই কমিটিকে বিব্রত করেছেন, যা অনভিপ্রেত।’
বিবৃতিতে অন্যান্যের মধ্যে স্বাক্ষর করেন জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, মো. ইলিয়াছ, মো. মহসিন, ছৈয়দ মো. এমরান রফিকুল ইসলাম।
১০। মুক্তিযোদ্ধা বাছাই কমিটি নিয়ে দুই জেলায় ক্ষোভ পটুয়াখালী ও বান্দরবান ২৫ জানুয়ারি ২০১৭
পটুয়াখালীর গলাচিপা ও বান্দরবানে জেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে গলাচিপায় বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। আর বান্দরবানে বাইরের মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে জেলার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কমিটি গঠনের দাবি উঠেছে। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালীর গলাচিপায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা। তবে সেখানে বিতর্কিত লোকজন নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে অভিযোগ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন, এ কমিটির সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধা নন—এমন ব্যক্তিরা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরোধ কমিটি’ নামে পৃথক একটি কমিটি গঠন করেছেন।
গত সোমবার সন্ধ্যায় গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এক সভায় উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল কালাম মোহাম্মদ ঈসাকে আহ্বায়ক করে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। মোহাম্মদ ঈসা অভিযোগ করেন, এই উপজেলায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ২৪ জন। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে ৪১ জন অমুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হন। বর্তমানে আরও ২৫৬ জন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার আবেদন করেছেন। যাঁদের বাছাই কমিটিতে রাখা হয়েছে, তাঁদের অনেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন।উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লা আল বাকী বলেন, ‘বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন। বাছাই কমিটি গঠনে আমাদের কিছু করার নেই।’বান্দরবানে ১১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিলের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের কমান্ডার আবুল কাশেম চৌধুরীসহ যাচাই-বাছাই কমিটির নয়জনকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা অভিহিত করে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল কাশেম বলেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে নতুন আবেদনকারী এবং মুক্তিযুদ্ধ না করেও যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন, তাঁরাই যাচাই-বাছাইয়ে টিকতে পারবেন না আশঙ্কায় গোলমাল পাকাচ্ছেন।জেলা প্রশাসক কার্যালয়-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এ জেলায় ৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পান। এবার আরও প্রায় ১০০ জন এই তালিকায় অন্তর্ভুক্তির আবেদন করেছেন।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে বান্দরবানের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও সাবেক উপসচিব আবদুল ওহাব বলেন, জেলায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২৫-৩০ জনের বেশি হওয়ার কথা নয়। তালিকাভুক্তি স্থানান্তরের দাপ্তরিক কোনো দলিলপত্র ছাড়া বিভিন্ন জেলা থেকে এ জেলায় এসে অনেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
১১। সাক্ষাৎকার : মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক আবেদন দেড় লাখ হলেও পাঁচ হাজারের বেশি নতুন মুক্তিযোদ্ধা হবে না
মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি করতে গত ১২ জানুয়ারি গেজেট প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়। গঠন করা হয় ৪৮৮টি উপজেলা ও ৮টি মহানগর কমিটি। এই কমিটি কাজ শুরু করে গত ২১ জানুয়ারি। কোথাও কোথাও এই কমিটিতে পরিবর্তন আনছে মন্ত্রণালয়। কারণ, একাধিক কমিটির বিরুদ্ধেই অনিয়মের অভিযোগ এসেছে। কমিটিতে অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন—এমন অভিযোগও কারও কারও। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য এরই মধ্যে অনলাইনে জমা পড়েছে প্রায় দেড় লাখ আবেদন। এ ছাড়া প্রতিদিনই আবেদন আসছে। সার্বিক বিষয়ে গতকাল বুধবার প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রোজিনা ইসলাম
প্রথম আলো: মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যদের নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। আপনি কি মনে করেন সেই কমিটি দিয়ে নতুন তালিকায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে?
মোজাম্মেল হক : মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তো আর কারও কাছ থেকে জোর করে টাকা নেননি। তাহলে তো মামলা হতো। নিজেদের সুবিধার জন্য স্বেচ্ছায় লোকে টাকা দিয়েছেন। আর যাঁরা টাকা দিয়েছেন, তাঁরা সবাই অমুক্তিযোদ্ধা। আর অমুক্তিযোদ্ধাদের কোনোভাবেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ নেই। কমান্ডার বা যিনি অভিযুক্ত, তিনি যাচাই-বাছাই কমিটির সাতজনের মধ্যে একজন সদস্য। আর প্রত্যেক আবেদনকারীর সাক্ষাৎকার হচ্ছে উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায়, অর্থাৎ সবার সামনে। এর মধ্যে উপস্থিত একজন ব্যক্তিও যদি আপত্তি তোলেন, তবে অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি কোথায় যুদ্ধ করেছেন, কোথায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাঁর কমান্ডার কে ছিলেন? তাঁর সহযোদ্ধা কে ছিলেন? কার নেতৃত্বে যুদ্ধ—এ ধরনের জবাব সঠিকভাবে দিয়ে কমিটি ও উপস্থিতদের সন্তুষ্ট করতে পারলেই তিনি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
প্রথম আলো: নতুনভাবে দেড় লাখ ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। কতজন নতুন মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন?
মোজাম্মেল হক : পাঁচ হাজারের বেশি নতুন হবে বলে আমার মনে হয় না।
প্রথম আলো: দফায় দফায় কমিটি বদল করা হচ্ছে কেন?
মোজাম্মেল হক: দেড় বছর আগে একবার কমিটি করা হয়েছিল। এরপর কিছু কমিটি নতুন করে করা হয়েছে। সারা দেশ থেকে কারও সুপারিশে কোনো কমিটি করা হয়নি। তবে আলাপ-আলোচনা করা হয়েছে। তারপরও যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তাঁদের বাদ দিয়ে সংশোধিত কমিটি প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো কোনো কমিটি বাতিলও করা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে কমিটিতে অন্য উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা ঢুকে গেছে। তাই এসব সংশোধন করতে হয়েছে।
প্রথম আলো: যাচাই-বাছাই কবে শেষ হবে? কীভাবে যাচাই-বাছাই করে তালিকায় নতুন মুক্তিযোদ্ধা অন্তর্ভুক্ত করবেন?
মোজাম্মেল হক: ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ যাচাই-বাছাই শেষ হবে। সে হিসাবে ২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সারা বাংলাদেশের প্রতিবেদন আসবে। ইতিমধ্যে আমাদের কাছে প্রতিবেদন আসা শুরু হয়েছে। যেসব প্রতিবেদন আমাদের কাছে পাঠানো হবে, উপজেলা অফিসে তার নামের তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হবে। যদি কেউ বাদ পড়ে যান, তবে মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে পারবেন কে বাদ পড়ে গেলেন।
প্রথম আলো: দু-একটি প্রতিবেদন এসেছে, তাতে কতজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন?
মোজাম্মেল হক: অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের কাছে যে তথ্য এসেছে, তাতে বেশির ভাগ থানাতেই ২০০ জন যেখানে আবেদন করেছেন, সেখানে দু-তিনজনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা গেছে। এর মধ্যে অনেকেই দু-তিনবার আবেদন করেছেন। এমনও আছে, ভারতীয় তালিকায় ও মুক্তিবার্তায় নাম থাকার পরও আবেদন করেছেন। কিন্তু তাঁদের দরকার ছিল না আবেদন করার।
প্রথম আলো: 
আপিলের সুযোগ থাকবে কি?
মোজাম্মেল হক: যাঁরা মনে করবেন ন্যায়বিচার পাননি, তাঁরা অবশ্যই আপিল করতে পারবেন। এ ছাড়া কমিটি মুক্তিযোদ্ধা করার পর যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবেন। এটা পুনরায় যাচাই-বাছাই হবে।
প্রথম আলো: অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
মোজাম্মেল হক: সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছে—এমন প্রমাণিত হলে তিন বছর জেল হবে।
প্রথম আলো: প্রবাসে যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই আবেদন করতে পারেননি। তাঁদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
মোজাম্মেল হক: যাঁরা বিদেশে অবস্থান করছেন, তাঁদের আগামী মার্চ মাসে ফরম পাঠানো হবে। ওখান থেকে হাইকমিশনের মাধ্যমে ফরম পূরণ করে পাঠানো হবে।
প্রথম আলো: মুক্তিযোদ্ধাদের ডিজিটাল কোডসংবলিত সার্টিফিকেট ও আইডি কার্ড দেওয়ার কত দূর?
মোজাম্মেল হক:আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা সম্পন্ন করে তাঁদের হাতে সনদ ও পরিচয়পত্র তুলে দেওয়া হবে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটা তৈরি করা হচ্ছে। টাকা জাল করা সম্ভব হলেও এ সনদ জাল করা সম্ভব হবে না। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে আট ধরনের ডিজিটাল কোডসংবলিত সার্টিফিকেটের নমুনা প্রস্তুত করা হয়েছে।